প্রশ্ন,
চিনে বক্সার বিদ্রোহের পটভূমি আলোচনা কর? (কারণ / প্রেক্ষাপট)
ঐতিহাসিকরা একটি বিষয় মোটামুটি সুনিশ্চিত যে বক্সার বিদ্রোহ ছিল মূলত বিদেশি বিরোধী অভুত্থান বিদ্রোহীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশীদের চীন থেকে বিতাড়িত করে চীনের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। আফিম যুদ্ধ চীনারা পরাজয়ের পর থেকেই চিনে বিদেশি শক্তি নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি অভ্যন্তরীণ বিষয় পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের হস্তক্ষেপ এবং অর্ধশতাব্দী ধরে বিদেশীদের সদম্ভ উপস্থিতি চীনের মানুষকে পিরিত করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ চীনে নির্লজ্জ লুন্ঠনের নীতি গ্রহণ করেছিল। বদমেজাজি, বিদেশীমন্ত্রী ও কনসালেরা এবং আগ্রসি খ্রিস্টান মিশনারিরা প্রায়ই চিনের সাধারণ মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করতেন। ফলে চীনাদের জাতীয়তাবাদী দম্ভ এবং আত্মমর্যাদা আহত হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই চীনারা বিদেশীদের বিরুদ্ধে তাদের রোষ ধুমাইত হয়ে উঠেছিল। এই পটভূমিকার সাথে অবশ্য যুক্ত হয়েছিল কতগুলি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ। তারই পরিপ্রেক্ষিতে চীনের বক্সার বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল।
খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব - কনফুসিয়, তাও এবং বৌদ্ধ ধর্মের দেশে খ্রিস্টধর্মকে কেউ পছন্দ করত না। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে টিয়েন্টসিন সন্ধিদয়ের শর্তানুসারে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকগণ চীনের অভ্যন্তরে বিনা বাঁধায় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের অনুমতি পান এবং ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের পিকিং কনভেনশন অনুসারে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারকগণ গির্জা নির্মাণের উদ্দেশ্যে চীনা জমি ক্রয়ের অথবা জমির ইজারা গ্রহণের অধিকার পান। ফলে চীনের অভ্যন্তরে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই বিদেশী ধর্মের প্রচারে চীনের জাতীয় ধর্ম বিপন্ন হওয়ায় চীনা রক্ষণশীল সম্প্রদায় বিশেষত জেন্ট্রি শ্রেণি বিচলিত হয়। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত চিনারা আচারে-আচরণে নিজদিগকে এক উচ্চ মানে স্বতন্ত্র শ্রেণি হিসেবে গণ্য করে এবং অখ্রিষ্ঠানদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। তারা দেশীয় দেব-দেবীর সম্মুখে নতজানু হয়ে প্রণাম জানাতে অথবা পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি নিদর্শন করতে অথবা স্থানীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করতে বিরত থাকে। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত চীনাদের এরূপ মনোবৃত্তি যে খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষা প্রসূত - একথা সংখ্যাগরিষ্ঠ রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের বুঝতে বিলম্ব হয় না। অখ্রিষ্টানগন গির্জার গাত্রে নানাবিধ চিত্র অঙ্কিত করে খ্রিস্ট ধর্মকে হেও প্রতিপন্ন করতে সচেষ্ট হয় এবং খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার বন্ধ করার প্রয়োজন অনুভব করে। সেই জন্য বিদেশি বিতরণ অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হয়।
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনরোষ - ১৮৯৭ - ৯৮ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ বিদেশি শক্তিবর্গ যখন চীনকে নিজেদের প্রভাবধীন অঞ্চলে ভাগ করে নেয়, তখন চীনারা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের স্বাধীনতা লুপ্তির ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। চীনে সংস্কার আন্দোলনের (১৮৯৮) নেতা - 'কাং ইউ ওয়েই' এর ১৭ই এপ্রিল জাতীয় সুরক্ষা সমিতি (National Protection Society) - এর সদস্যদের সামনে একটি বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন -
"এইভাবে বিদেশি অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে চীন অচিরেই বর্মা, আন্নাম, ভারতবর্ষ বা পোল্যান্ডের মতো একটি পরাধীন দেশে পরিণত হবে।"
প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা একটি প্রতিষ্ঠানিক সংস্কারের মধ্যে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশ রোধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চীনের সাধারণ মানুষ সাম্রাজ্যবাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকে বিদেশিদের হত্যা করতে আরম্ভ করেন।
চীনের জনজীবনে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব - আফিন যুদ্ধ চীনের অর্থনীতি কে কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল - একথা আগেই আলোচিত হয়েছে। বিদেশি পণ্য চীনের বাজার ছেয়ে দিয়েছিল। বিদেশি বস্ত্র চীনা বস্ত্রের এক তৃতীয় অংশ মূল্য পাওয়া যেতে লাগলো। ফলে এই অসম প্রতিযোগিতার সামনে চিনা হস্তশিল্প ভেঙে পড়ে। তাইপিং পরবর্তী যুগে চীনের বাজারে বিদেশি পণ্যের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পায়। ১৮৫১-১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বহু সংখ্যক বিদেশি ধাঁচের উদ্যোগ ও শিল্প চীনে গড়ে ওঠে। চীনে বিদেশি পূজার অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। ফলে চীনের আর্থিক স্বাধীনতা ব্যাহত হয়। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে চীনের বাণিজ্যিক ঘাটটির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৯ মিলিয়ন টেইল। সরকারি বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ হয় ১২ মিলিয়ন টেইল। এই ঘাটতি মেটানোর জন্য সরকার করের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। কর ঘরে জর্জরিত সাধারণ মানুষ দস্যুবৃত্তির আশ্রয় নেন অথবা বিভিন্ন গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেন। ১৮৮৫-১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বৈদেশিক বাজারে ঘটনা স্রোতের জন্য সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চীনের চা উৎপাদকেরা। ভারতবর্ষ, সিংহল ও জাভাতে চা উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিশ্বের বাজারে চিনা চা এর মূল্য হ্রাস পেতে থাকে। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে চীনে উৎপাদিত কালো চা এর ৫০ কিলোগ্রামের মূল্য ছিল ২২•১৪ ডলার। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সমপরিমাণ কালো চায়ের মূল্য হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১১•০৯ ডলার। বৈদেশিক বাজারে চীনের সাধারণ চায়ের চাহিদা একেবারেই কমে যায়। সাম্রাজ্যবাদ চীনের সাবেকই হস্তশিল্পকেই কেবল ধ্বংস করেনি, সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবের ফলে চীনের প্রথাগত কৃষি অর্থনীতিও ভেঙে পড়ে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষির সংকট- উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি চীনে কৃষি সংকট বাড়িয়ে তুলেছিল। অ্যালবার্ট ফুয়ের ওয়ার্কারের " The Chinese Economy"-(১৮৭০-১৯১১) নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে , ১৮৭৩-৯৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ৮% , অথচ একই সময়ে চীনের কৃষি যোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ১% , অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে কৃষি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি অত্যন্ত নগন্য। ফলে জমিতে ভিড় উপচে পড়ে এবং চাষীদের কৃষিজমের মাপ ক্রমশ ছোট হতে থাকে। তৎকালীন সময়ে কৃষিতে পুঁজির বিনিয়োগ ছিল অত্যন্ত সামান্য। ফলে উন্নত মানের সার, বীজ বা প্রযুক্তি বিদ্যার সাহায্যে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল। ভাড়াটে চাষীদের উৎপাদনের অর্ধেক বা কোন কোন ক্ষেত্রে ৮ দশমাংশ পর্যন্ত কর দিতে হতো। এতে একজন ভাড়াটে চাষীর ক্ষেত্রে তার পরিবারের ভরণ পোষণ অতি কষ্ট সাধন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তারা যখন মহাজনের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হতেন এবং ঋণের ভারে জর্জরিত হতেন তখন কিছুদিনের মধ্যে তাদের ভূমি যুদ্ধ করা হতো। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভূমিহীন চাষী, ভবঘুরে এবং ভিখারীর সংখ্যা চিনে বহু অংশ বৃদ্ধি পায়। এরাই পরবর্তীকালে বক্সার বিদ্রোহের ঘোষণা করে।
চীন-জাপান (১৮৯৫) ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া - জাপানি সৈন্যবাহিনী চীনাদের পরাজিত করার ফলে চীনে বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত উত্তর চীনের গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায়। এই ধ্বংসলীলার ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। জাপান জীবিত চীনের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের এক বিপুল অংশ দাবি করেছিল। এই ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য চীনা রাজ্সভা জনসাধারণের উপর করের বোঝা চাপিয়ে দেন। খ্রিস্টান মিশনারিদের অপকীর্তি, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের কুপ্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং কৃষি সংকট গ্রামাঞ্চলের মানুষদের বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। তার মধ্যে বর্ধিত করভার তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে চীনের গ্রাম অঞ্চল হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। মিশনারীদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা, দস্যুবৃত্তি গ্রামাঞ্চলের নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। শানটুং প্রদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল তার মধ্যে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে সীমান্ত রক্ষার জন্য শানটুং অঞ্চল থেকে প্রতিবছর ৯০ হাজার টেইলের অধিক কর আদায় করা হবে। এই ঘোষণার সাথে সাথে শানটুং-এর মানুষ তাদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ বাড়িয়ে দেয়। শানটুং ছিল কনফুসিয়াসের জন্মস্থান অথচ এখানেই প্রোটেস্ট্যান্ট এবং রোমান ক্যাথলিকদের কার্যকলাপ ছিল অত্যন্ত বেশি। শানটুং- এর প্রায় ৮০ হাজার চিনা খ্রিস্ট ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তদুপরি মিশনারিরা এখানে বেআইনিভাবে জমি দখল, অপরাধীদের মদত দেওয়া, অখ্রিষ্টানদের উপর অত্যাচার করা, অসাধু ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকা প্রভৃতি অপকর্মে লিপ্ত ছিল। সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মিশনারিদের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও করের বোঝা বৃদ্ধি যখন তাদের অবস্থা শোচনীয় করে তোলে, তখন তাদের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ক্রিস্টান মিশনারীদের উপর। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে গ্রামাঞ্চলে যে হিংসাত্মক ঘটনা চলেছিল ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তা একটি বিদেশি বিরোধী বিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল। শানটুং অঞ্চলে মিশনারীদের উপর আক্রমণের মধ্যে দিয়েই বক্সার অভ্যুত্থানের সূত্রপাত।
আরো পড়ুন:- কঙ্গ সংকট সম্পর্কে আলোচনা কর? CLICK HERE
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন