প্রশ্ন,
ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমীরের ভূমিকা আলোচনা করো ।
অথবা,
মির নিসার আলী - 'বারাসাত বিদ্রোহ' সম্পর্কে লেখ?
উত্তর:- মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর সর্বক্ষেত্রে যে ইসলামের অবক্ষয় ঘটে তার বিরুদ্ধে ইসলামকে বিশুদ্ধ রূপে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে যে সংস্কারমুখী আন্দোলন শুরু হয় তার মধ্যে ওয়াহাবি আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম হল - তারিখ -ই-মহম্মদীয়া। অষ্টাদশ শতকে আব্দুল ওয়াহাব এর নেতৃত্বে এই আন্দোলনের সূচনা হলেও স্যার সৈয়দ আহমেদের নেতৃত্বে ভারতে এই আন্দোলনে প্রকৃত প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর তারই পথ অনুসরণ করে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মীর নিসার আলী বা তিতুমীর।
২৪ পরগণায় একই সব পরিবারের জন্মগ্রহণ করে তিনি গ্রামের এক মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন এবং ফরাসি ও বাংলায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করে। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মক্কায় হজ যাত্রা করতে গিয়ে তিনি সৈয়দ আহমেদের সংস্পর্শে আসেন। বাংলায় ফিরে এসে তিনি জমিদারদের অধীনে কাজ না করে দরিদ্র চাষী, জেলে বা তাঁতিদের ওয়াহাবি মতাদর্শে দীক্ষিত করেন। ১৮৩২-এ এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায় তিতুমীরের অনুগামীরা মূর্তি পূজা, পীরের পূজা, নানা ধরনের কুসংস্কারের বিরোধী ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ২৪ পরগনা, রাজশাহী, ঢাকা, মালদহ প্রভৃতি অঞ্চলে ওয়াহাবি সংগঠন গড়ে ওঠে। বহু নির্যাতিতা হিন্দু তাদের সাথে যোগ দেয়। তিতুমীরের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবরা। আর সেই সূত্রে তিনি কোম্পানির সাথে সংগ্রামে নামতে দ্বিধারোধ করেননি।
তিতুমীরের সাথে প্রথম সংঘাত বাঁধে জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের। কৃষ্ণদেব রায় তিতুমীরের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা হ্রাস করার জন্য কয়েকটি ব্যবস্থা নেন। তিতুমীরের শিশুদের দাঁ ড়ি রাখতে হত বলে তিনি ঘোষণা করেন যারা ওয়াহাবি হবে ও দাড়ি রাখবে তাদের জরিমানা দিতে হবে।। এর ফলে দরিদ্র, মুসলমান ও কৃষকরা সংঘটিত। এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণদেব রায় তিতুমীরের কয়েকটি গ্রাম আক্রমণ করে এবং কয়েকটি মন্দির অগ্নিসংযোগ করে দেয়। কিন্তু তাতেও কোন ফল না হয় কৃষ্ণদেব রায় ওয়াহাবীদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে তিতুমীর ও ওয়াহাবিরা কৃষ্ণদেব রায়ের বাসস্থান আক্রমণ করে। একই সঙ্গে নীলকুঠি ও জমিদারদের কাছারি বাড়িতে আক্রমণ চালায়।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তিতুমীরের বিদ্রোহ জমিদার ও নীলকর বিরোধী সংগ্রামে পরিণত হয়। নারকেলবেরিয়া গ্রামে একটি বাসের কেল্লা তৈরি করে সেখানে তার সদর দপ্তরে স্থাপন করেন এবং তাকে ' বাদশাহ ' বলে ঘোষণা করা হয়। জমিদারদের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ 'বারাসাত বিদ্রোহ' নামে পরিচিত। এইভাবে প্রায় দু বছর ধরে ইংরেজিদের সাথে তিতুমীরের ব্যাপক সংঘর্ষ বাঁধে। জমিদাররা নিরাপত্তার অভাবে ইংরেজদের সাহায্য প্রার্থী হয়। শেষ পর্যন্ত বেন্টিংকের নেতৃত্বে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে সেনাবাহিনী ভেঙে পড়ে ও নারকেল বেরিয়া আক্রমণ করেন। শেষ পর্যন্ত ওলন্দাজ বাহিনীর সামনে বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে ৩২ বছর বয়সে তিতুমীর নিহত হন।
তিতুমীরের আন্দোলনের চরিত্র নিয়ে বিতর্ক আছে। বিহারীলাল সরকার, কুমুদনাথ মল্লিক তিতুমীরের আন্দোলনকে "ধর্ম ও উন্মাদ মুসলমানদের কান্ড" এবং হিন্দু বিরোধী আন্দোলন বলে চিহ্নিত করেছেন। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন ওই বিদ্রোহ ছিল - হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগঠিত আন্দোলন। রমেশ চন্দ্র মজুমদার একে নিছক সাম্প্রদায়িক আন্দোলন বলে চিহ্নিত করেছেন। নরহরি কবিরাজ এই আন্দোলনে জমিদার, নীলকর ও ইংরেজ বিরোধিতা লক্ষ্য করেছেন। বিনয় ভূষণ চৌধুরী মনে করেন, তিতুমীরের সংগ্রাম ছিল জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
তবে যাই হোক না কেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু মুসলমান দরিদ্র কৃষক ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। হিন্দু মুসলমান সংস্কৃতির সমন্বয়ে ভারতে এক মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তবে সাম্প্রদায়িকতার কারণে এই আন্দোলনে ভারতের পক্ষে সুফল প্রসব করেনি।
আরো পড়ুন - মুর্শিদকুলি খাঁর মাল যামিনী ব্যবস্থা আলোচনা কর - Click here
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন