প্যারিস বিদ্রোহের বা প্যারিকমিউনের কারণগুলি আলোচনা করো?
অথবা,
প্যারিস বিদ্রোহ বা প্যারিকমিউন - কিভাবে সংঘটিত হয়?
উঃ - ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন প্রাশিয়ার কাছে পরাজিত ও বন্দী হলে ফ্রান্সের দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে এবং ফ্রান্সে অস্থায়ী প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। অস্থায়ী প্রজাতান্ত্রিক সরকার জন্ম লগ্ন থেকে যে বৃহৎ অভ্যন্তরীণ সমস্যার সম্মুখীন হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল - প্যারিকমিউন বিদ্রোহ। ১৮৭১ সালের মার্চ মাস থেকে এই বিদ্রোহ শুরু হলেও প্যারিস ছাড়া লিয়, মার্সাই, তুঁলো প্রভৃতি শহরে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহ সংঘটিত হবার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কারণগুলি দায়ী ছিল -
১) প্যারিস নগর গুলি ছিল বিপ্লবের কেন্দ্রীভূমি। প্যারিসের মানুষ প্রাশিয়ার হাতে ফ্রান্সের পরাজয় ও বসতা স্বীকার কখনোই অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেনি। তারা মনে করত প্রজাতান্ত্রিক ফ্রান্সের যোগ্য রাজধানী হল প্যারিস নগরী। কিন্তু প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্যারিস কে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন না করে ভার্সাই নগরীতে প্রতিনিধি সভা স্থাপন করলে প্যারিসের আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে।
২) ভার্সাই নগরি ছিল রাজতান্ত্রিক ফ্রান্সের ঐতিহাসিক রাজধানী। এখন জাতীয় সভা নির্বাচনে রাজতন্ত্রীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। প্যারিসের মানুষের মনে এই আশঙ্কা ডানা বাঁধে যে ভার্সাইতে নতুন সরকারের প্রধান কেন্দ্র স্থাপিত হলে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভাবনা প্রবল হবে।
৩) প্যারিসের পরিবর্তে জাতীয় সভার অধিবেশন ভার্সাই নগরীতে অনুষ্ঠিত হওয়ায় তারা রুষ্ট হয়। তাদের দৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত ছিল ঐতিহ্যবাহী প্যারিসের পক্ষে অপমানজনক।
৪) জার্মান আক্রমণের বিরুদ্ধে প্যারিসের নাগরিকরা তাদের প্রাণ দিয়ে বাঁধা দেয়। প্যারিসের প্রতি গৃহে দূর্গের ন্যায় জার্মানদের প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত খাদ্যাভাবে প্যারিস জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। এই ঐতিহাসিক প্রতিরোধে ত্যাগ স্বীকারের বিনিময়ে প্যারিসকে রাজধানী হিসেবে স্বীকার না করায় এই নগরীতে প্রবল হতাশা দেখা যায়।
৫) ভার্সাই শহরের রাজধানীর স্থাপিত হবার ফলে প্যারিসের বণিক ও দোকানদাররা আশঙ্কিত হয় এই ভেবে যে, সরকারি অনুকূল্যে ভার্সাই নগরী শ্রীহীন হয়ে পড়বে। জার্মানির সেনা প্যারিস অবরোধ করলে প্যারিসের কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়, বেকার শ্রমিকরা কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য জাতীয় রক্ষী বাহিনীতে যোগদান করেন, প্রজাতন্ত্রী সরকার প্যারিসের এই রক্ষী বাহিনীর ভাতা বন্ধ করলে বহু মানুষ জীবিকা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। অস্থায়ী সরকার প্যারিসের নাগরিকদের বকেয়া কর, বাড়ির খাজনা ইত্যাদি পরিশোধের নির্দেশ দিলে মানুষের দুর্ভোগ চরমে ওঠে।
৬) ১৮৪৮ শের জুন মাসে বুর্জোয়া সরকারের শ্রমিক শ্রেণীর উপর ভয়াবহ নিপীড়ন শ্রমজীবী মানুষকে চিন্তিত করে তোলে। ইতিমধ্যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সাথে শ্রমজীবীদের পরিচয় ঘটে। এদের কাছে শুধুমাত্র প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই শেষ কথা ছিল না। ধর্ম বন্টন, উৎপাদন ব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির দাবিই ছিল বিপ্লবের মূল কারণ।
৭) প্যারিসের বিপ্লবীদের দাবি ছিল সরকারের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। রাজতন্ত্রী যুগে গ্রাম ও শহর গুলির স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থা লোপ পায়। তারা দাবি করেন যে প্রতি অঞ্চলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে 'কমিউন' গঠন করা হবে। গৃহীত হয় ৯০ জন সদস্য দ্বারা 'প্যারিকমিউন'। কমিউনিস্ট সোসালিস্ট সমাজতন্ত্রীরা সহ বিক্ষুব্ধ জাতীয় রক্ষী বাহিনী অস্ত্র হাতে কমিউনের পাশে এসে দাঁড়ায়। ২রা এপ্রিল ভার্সাই সরকার প্যারিসের উপর আক্রমণ করে এবং ওই বছরই ২১ শে এপ্রিল ভাষায় বাহিনী প্যারিসে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালালে বহু মানুষ মারা যায়। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্যারিকমিউনের পতন ঘটে।
আরো পড়ুন - ওয়াহাবি আন্দোলনে তিতুমীরের ভূমিকা? CLICK HERE
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন