ত্রিশক্তি আঁতাত কিভাবে গড়ে ওঠে?
অথবা
ত্রিশক্তি আঁতাতের পটভূমি ব্যাখ্যা কর।
-> ১৮৯৩ সালে ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বৈত সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯০৪ সালের ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে আঁতাত কড্রিয়েল বা মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ রুশ কনভেনশনের মাধ্যমে ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে মিত্রতা স্থাপিত হয়; এভাবে গড়ে ওঠে ত্রিশক্তি আঁতাত। জার্মানি নেতৃত্বাধীন ত্রিশক্তি মৈত্রীর বিরোধী জোট হিসেবে ফ্রান্স, রাশিয়া ও ব্রিটেনকে নিয়ে ত্রিশক্তি আতাতের উদ্ভব হয়। ফলে ইউরোপ দুটি শিবিরের বিভক্ত হয়ে পড়ে।
1. ফ্রাঙ্কো-রুশ মৈত্রী:- বিসমার্কের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের রাজনীতিতে ফ্রান্সকে মৈত্রী হীন রাখা । এই উদ্দেশ্যে তিনি অস্ট্রিয়া, ইটালি ও জার্মানিকে নিয়ে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ত্রিশক্তি মৈত্রী গঠন করেছিলেন। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাশিয়ার সাথে রিইন্সুরেন্স চুক্তি স্বাক্ষর করে ফ্রান্সের নির্বাব্ধকতাকে সুনিশ্চিত করে। কিন্তু বিসমার্কের পতনের পর জার্মান পররাষ্ট্রনীতিতে যে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয় তার ফলে রি-ইন্সুরেন্স চুক্তি বাতিল হয়। রাশিয়া ধীরে ধীরে ফ্রান্সের কাছে আসতে বাধ্য হয়। উভয় দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে বলে ঐতিহাসিক ট্রেলার মন্তব্য করেছেন। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া ফ্রান্সকে ঋণ হিসেবে প্রচুর অর্থ প্রদান করে। পরের বছর রাশিয়ার কাছ থেকে বন্ধু ক্রয়ের জন্য ফ্রান্স একটি বার্তা পেশ করে। অপরদিকে ফরাসি সম্রাট বহু সংখ্যক রুশ বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে। রাশিয়ার হাত থেকে প্রর্ত্যপন করে, এই ঘটনা রাশিয়ায় এক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। ফরাসি সেনাপতিকে রাশিয়ার শুভেচ্ছা সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সুতরাং ফ্রান্স রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর বিলম্ব করা উচিত নয় বলে মনে করে। ১৮৯৩ সালের সংকট প্রমাণ করে যে ফ্রান্স ব্রিটেনের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করতে ভীত নয়। তখন রাশিয়াও আর বিলম্ব করা সমিচিন মনে করেনি। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বৈত যুক্ত স্বাক্ষরিত হয়।
প্রথমতঃ- এই চুক্তিতে স্থির হয় যে ফ্রান্স যদি জার্মানি অথবা জার্মান সমর্থিত ইতালির দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে রাশিয়া ফ্রান্সকে সাহায্য করবে। অপরদিকে রাশিয়া যদি জার্মানি বা জার্মানির সমর্থনে অস্ট্রিয়া কর্তৃক আক্রান্ত হয় তাহলে ফ্রান্স রাশিয়াকে সাহায্য করবে। সন্দেহ নেই যে সন্ধির শর্তাবলী ছিল রক্ষণাত্মক অত্যন্ত গোপনীয়। ১৯১৮ সালের পূর্ব সন্ধির শর্তাবলি সঠিকভাবে ভাবা যায়নি।
দ্বিতীয়তঃ- জার্মানি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি সহনশীল মনোভাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং পরবর্তীকালে বহু আন্তর্জাতিক সংকটে জার্মানি উক্ত দেশের সাথে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়। আরো একটি বিষয় প্রকট হল রাশিয়া যদি তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করে তাহলে ফ্রান্সকে জার্মানির বিরুদ্ধে একা লড়তে হবে না।
2. ইঙ্গ-ফরাসি আতাঁত:- উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রিটেন ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার নীতি গ্রহণ করে। ফ্রান্স ও রাশিয়ার সাথে উপনিবেশিক বা বাণিজ্যিক স্বার্থের সরঘাত এই সময় ব্রিটিশ রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯০১ সালের পর জার্মানি শক্তি-কৌশল বৃদ্ধি পেতে থাকে, ফলে ব্রিটেন শঙ্কিত হয়। ১৯০২ সালে ব্রিটেনের সাথে জাপানের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। এর মাধ্যমে বৃটেনের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটলেও জার্মানিকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য ব্রিটেনকে ফ্রান্সের দিকে তাকাতে হয়। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় আঁতাত কার্ডিয়াল বা ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তি।
3. ইঙ্গ-রুশ কনভেনশন:- ইঙ্গ-ফরাসি চুক্তির ৩ বছর পর ১৯০৭ সালে ইঙ্গ-রুশ কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়। আঁতাত কার্ডিয়েলের পরেই জাপানের কাছে রাশিয়ার পরাজয় ঘটে। ১৯০৫ সালে জাপানের বিরুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় ইঙ্গ-রুশ সমস্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। এইভাবে জাপানের প্রতিপত্তি খর্ব করতে রাশিয়া যথেষ্ট উদ্যোগী হয়। ব্রিটেন জার্মান বিরোধী জোট শক্তিশালী করতে আগ্রহী ছিল। ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যে কূটনীতি আলোচনা শুরু হয়, স্বাক্ষরিত হয় ইঙ্গ-রুশ কনভেনশন (১৯০৭)।
ইঙ্গ-রুশ চুক্তি কোনো সামরিক চুক্তি ছিল না, ছিল একটি সমঝোতা মাত্র। যার ফলে কূটনৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়। কারণ 1890 সালে যখন জার্মানি রি ইন্সুরেন্স চুক্তি নবীকরণে রাজি হয় না, তখন এই বিপ্লব সংঘটিত হয়। ১৯০৭ সালের মধ্যে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি পরস্পর দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯১৪ সালে ইউরোপের শক্তি সাম্য এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে সেটি ছিল শান্তির পথে প্রধান প্রতিবদ্ধ যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে।
আরো পড়ুন -প্যারিস বিদ্রোহের বা প্যারিকমিউনের কারণগুলি আলোচনা করো? CLICK HERE
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন