উচ্চ মাধ্যমিক ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়
গুরুত্বপূর্ণ ৮ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন: রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য কি ছিল? ভারতের অর্থনীতিতে রেলপথের কি প্রভাব পড়েছিল ? অথবা ভারতে রেলপথ স্থাপনের ফলাফল লেখ।
উত্তর :
সূচনা : ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বোম্বে থেকে থানে পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন করে। ভারতে এই রেলপথ স্থাপনের পেছনে ইংরেজদের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। এই উদ্দেশ্যগুলি এর মধ্যেই রয়েছে রেলপথ গড়ে তোলার অন্তর্নিহিত কারণ। ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য গুলি ছিল -
1. অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য -
১. ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলে যে কারখানা তৈরি হয়েছিল সেই কারখানাগুলোতে ভারতের কাঁচামাল সহজে ও সুলভে বন্দরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রেলপথ স্থাপন করা হয়।
২. ইংল্যান্ডের কারখানায় উৎপাদিত পণ্য দ্রুত ভারতের সর্বোচ্চ পৌঁছে দেওয়া।
৩. শিল্প বিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের হাতে জমা উদ্বৃত্ত পুঁজি রেলপথ সহ অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে লগ্নির ব্যবস্থা করা।
৪. ভারতবর্ষে ইংরেজদের কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা
2. রাজনৈতিক উদ্দেশ্য :-
১. সুবিশাল ভারতীয় সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করা।
২. রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সু- প্রতিষ্ঠিত করা।
৩. প্রশাসনিক কাজে দ্রুত তদারকি করা।
3. সামরিক উদ্দেশ্য :-
১. ভারতের বিভিন্ন অংশে বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে দ্রুত সেনাবাহিনী পাঠানো।
২. বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কে রক্ষা করা।
৩.সেনাবাহিনীর কাছে দ্রুত খাদ্য,রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র পাঠানো।
4. বিপর্যয় মোকাবিলা :
ঔপনিবেশিক ভারতে দুর্ভিক্ষ সহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল নিয়মিত ঘটনা। এইসব বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য উপদ্রুত এলাকায় দ্রুত ত্রাণ ও খাদ্য পৌঁছানোর জন্য রেলযোগাযোগ অপরিহার্য ছিল।
এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুগত বসু এবং আয়েশা জালাল তাঁদের " Mordern South Asia" গ্রন্থে দেখিয়েছেন, বৃটেনের উপনিবেশিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই ভারতের রেলপথ স্থাপনের কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হয়েছিল। অধ্যাপক জে.এম.হার্ড যথার্থই বলেছেন, ' এর পিছনে যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যই ছিল, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই।'
রেলপথ স্থাপনের ফলাফল/প্রভাব
ডক্টর বিপান চন্দ্র বলেছেন, 'ভারতের রেলপথের প্রবর্তন ভারতীয় জনজীবন, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে'। এই পরিবর্তনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটো দিকই লক্ষ্য করা যায়।
ইতিবাচক দিক :-
১. প্রশাসনিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা:- রেলপথ প্রতিষ্ঠিত ফলে এ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটে। ফলে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য গড়ে ওঠে।
২. পরিবহনে উন্নতি :- রেল ব্যবস্থার প্রসারের ফলে ভারতে মানুষ ও পণ্য পরিবহনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ফলে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা অনেক সহজ হয়।
৩. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি:- রেল ব্যবস্থার প্রসারের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় কৃষি পণ্যের প্রবেশ ঘটে। ফলে, কৃষির উৎপাদন ও বাণিজ্য বাড়ে।
৪ অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধি:- রেলপথের মাধ্যমে দেশের আভ্যন্তরীণ বাজার গুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ফলে, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও বৃদ্ধি পায়।
৫. রপ্তানি ও আমদানি বৃদ্ধি :-রেলের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে এবং দ্রুত কাঁচামাল বন্দরে পৌঁছে দেওয়া যেত। সেখান থেকে সহজে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে যেত। পরিসংখ্যান বলছে, ১৮৬২- ১৯২৮ সালের মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যে প্রায় ২.৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। একই কারণে ইংল্যান্ডের কারখানায় উৎপাদিত শিল্পপণ্য সহজেই দেশের বাজারে চলে আসতো। তাই ১৮৬২ -১৯২৮ সালের মধ্যে আমদানি বাণিজ্য তিনগুণ বৃদ্ধি পায়।
৬ . শিল্প স্থাপন:- কাল মার্কস বলেছিলেন, 'The railway system will become, in India, truly the the fore runner of modern industry .' অর্থাৎ রেলপথ ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের প্রকৃত অগ্রদূত হবে। বাস্তব ক্ষেত্রে রেলপথ কাঁচামালের যোগান, উৎপাদিত পণ্য বাজারে পৌঁছে দিয়ে আধুনিক শিল্পের বিকাশে সাহায্য করেছিল।
৭. কর্মসংস্থান :- রেলপথ নির্মাণ রেল কারখানা ও পরিবহনের জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করে। ১৮৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী নিযুক্ত কর্মীর সংখ্যা ২ লক্ষ ৭৩ হাজার ছিল।
৮. জাতীয় ঐক্য স্থাপন:-রেলপথ ব্যবস্থা সূত্রে ভাষা, ধর্ম ও গোষ্ঠীগত বিভেদের প্রাচীর ভেঙে দেশবাসী পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ ও মতামত আদান প্রদান করতে সক্ষম হয়। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয়তা বোধ গড়ে ওঠে।
নেতিবাচক প্রভাব :
তবে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক রেল ব্যবস্থা কে সুনজরে দেখেন নি তাদের নজরে বেশ কিছু নেতিবাচক দিক ফুটে উঠেছে যেমন-
১ সম্পদের বহির্গমন: -রেলপথ নির্মাণে গ্যারান্টি প্রথার কারণে বার্ষিক 5 পার্সেন্ট হারে সুদ এবং সেই সঙ্গে মুনাফা ধরলে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ইংল্যান্ডে চলে যেতে থাকে। এই বিষয়কে সম্পদের বহির্গমন বলা হয়।
২. ভারী শিল্পের অনগ্রসরতা:- রেলের যাবতীয় যন্ত্রাংশ ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হতো এর ফলে এই বিষয়ে এখানে কোনো ভারী শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
৩ কর্মসংস্থানে বৈষম্য:-রেল কে কেন্দ্র করে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি হলেও তার অধিকাংশ পদে ইউরোপীয়দেরই নিয়োগ করা হতো । রেলওয়ে উচ্চপদ গুলিতে ভারতীয় নিয়োগের হার ছিল মাত্র 10%।
৪. দেশীয় শিল্প বাণিজ্য অবক্ষয়:- রেল এর মাধ্যমে বিলাতি শিল্পপণ্য ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ফলে দেশীয় পণ্যগুলি অসম প্রতিযোগিতায় সম্মুখীন হয়। এর ফলে দেশীয় শিল্প বাণিজ্য গুলি মার খায়।
৫. বৈষম্যমূলক রেল মাশুল :- পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে ভারতীয়দের বেশি মাশুল দিতে হতো। ফলে দেশীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৬. দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব:- রেলপথের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্যও বিদেশে রপ্তানী হতে শুরু করে এর ফলে ভারতে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা যায় এবং যার পরিণামে ঘনঘন দুর্ভিক্ষ হতে থাকে।
৭. অন্যান্য পরিবহনে ক্ষতি:-রেলপথ পরিবহন বৃদ্ধির ফলে অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই মাধ্যমে নিযুক্ত শ্রমিকরা অনেকেই বেকার হয়ে পড়ে।
৮. শাসনের ফাঁস কঠিন :-ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা সামান্য সম্ভাবনা দেখা দিলেই রেলপথে সেনা পাঠিয়ে তা দমন করা সহজ হয়ে যায়। ফলে শাসনের ফাঁস আরো কঠিন হয়। ঐতিহাসিক বুকানন এ প্রসঙ্গে বলেছেন ' স্বনির্ভরতার যে বর্ম ভারতের গ্রামগুলোকে এতদিন রক্ষা করে এসেছিল, ইস্পাতের এল সেই বর্ম ভেদ করে গ্রামজীবনের রক্ত শোষণ করতে শুরু করে।'
মূল্যায়ন:-
পরিশেষে সার্বিক বিচারে বলা যায় ব্রিটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে এই যে রেলপথ স্থাপন করেছিল সে কথা নিঃসন্দেহে এক বাক্যে স্বীকার করতে হয়। এর ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ভারতীয় জনজীবনে ইতিবাচক প্রভাব অপেক্ষা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল যথেষ্ট। তবে পরবর্তীতে স্বাধীনতার পর এই রেলপথের মাধ্যমে ভারত শিল্পায়নের পথে অগ্রসর হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন